টানা ১৫ বছরের অধিক সময় ক্ষমতার আসনে ছিল আওয়ামী লীগ। ছাত্র-জনতার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে দলটি। এত বছর ক্ষমতায় থাকার সুবিধা নিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করার কথা থাকলেও তা না করে ব্যক্তিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
ক্ষমতা হাতেগোনা কয়েকজনের কাছে কুক্ষিগত থাকায় মূল্যায়ন করা হয়নি দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের। এ কারণে দুঃসময়ে কাউকে পাশে পাচ্ছে না দেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দলটি। মুষ্টিমেয় নেতার কারণে অবহেলিত ছিলেন দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশ নেতা। হঠাৎ ক্ষমতাচ্যুতির জন্য দুর্নীতিবাজ আর দুর্বৃত্তপরায়ণ নেতাদের দুষছেন আওয়ামী লীগের অনেক কেন্দ্রীয় নেতা।
আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, নানা কৌশলে দীর্ঘদিন টানা ক্ষমতায় থেকে যেতে পারায় দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি। মূল্যায়ন করা ছাড়াই যেহেতু সব ঠিকঠাক চলছিল তাই এদিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বরং ব্যবসায়ীদের দিকে ঝুঁকে যাওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে দলটির নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে ৬০ শতাংশের বেশি সংসদ সদস্যের চেয়ার ছিল ব্যবসায়ীদের জন্য বরাদ্দ। যেখানেই টাকাওয়ালা পাওয়া গেছে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায়েও মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে। বাদ পড়েছেন দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতারা। আবার এমপি কিংবা মন্ত্রীর আত্মীয়রাও বাগিয়ে নিতেন উপজেলা বা ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের মনোনয়ন। সব জায়গায় আত্মীয়করণের প্রবণতা ছিল প্রবল।
আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা হয় । সেই তালিকায় রয়েছেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ বেশ কয়েকজন সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। তারা কেউ ঢাকায় অবস্থান করছেন, আবার কেউ দেশের বাইরে। তাদের মধ্যে একজন সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, ‘ওরা দেশটা গিলে খাইসে, ওরা আওয়ামী লীগরেও গিলে খাইসে। আমাদের কথা শুনে নাই। আমার সঙ্গে কারও যোগাযোগ নাই। এখন রাজনীতিতে নাই। দেখি তারা কী করে। যারা আছে তারা দল চালাক।’
ওরা কারা? এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের ওই নেতা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি ছিল। সেটি নামেমাত্র ছিল। কমিটিকে এক সাইডে রেখে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ ছিল কয়েকজনের হাতে। তাদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত, সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ছিলেন ক্ষমতা চর্চার কেন্দ্রে। তারাই আওয়ামী লীগকে পরিচালনা করেছে। অনেক বিষয়ে তারা জানতেন কিন্তু দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানতেন না। এরা দলের হাইকমান্ডকে দেশের সঠিক পরিস্থিতি বা সঠিক তথ্য দিত না। সে কারণে আজ আওয়ামী লীগের এমন করুণ পরিণতি।’
আওয়ামী লীগের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আকার ছিল ৮১ সদস্য বিশিষ্ট। কিন্তু এখানে কয়জন সক্রিয় রাজনীতিবিদ ছিলেন? এমনও আছে, যাদের দেশের মানুষ চেনেই না। প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগের মতো দলে কেন অপরিচিত বা অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে ভেড়াতে হবে? তারা কি দলের দুর্দিনে থাকবে? এখন দেখেন তারা কিন্তু নেই। আমরা দলের থাকলেও দলের মধুটা কিন্তু উনারাই খেয়েছেন। সরকার পরিচালনা থেকে শুরু করে সব কিছুতেই তারা সামনের সারির লোক। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা বাড়াবাড়ি করেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগের একটি উপদেষ্টামণ্ডলীর কমিটি রয়েছে। সেখানে অনেক অভিজ্ঞ নেতা ছিলেন। করোনা মহামারির আগ পর্যন্ত নেত্রী তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতেন। পরবর্তীতে হাইব্রিডরা নেত্রীর আশপাশে ভিড়তে থাকে। তাকে সিনিয়রদের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলে। নেত্রীর আশপাশে সিনিয়ররা থাকলে এমন আন্দোলন মোকাবিলা করা কোনো বিষয় ছিল না। আমার কাছে মনে হয়, সঠিক তথ্যটাই নেত্রী পাননি।’
১৯৪৯ থেকে ২০২৪ সাল, অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে প্লাটিনাম জয়ন্তী পালন করেছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। কেটে গেছে দলটির সংগ্রামী পথচলার পঁচাত্তর বছর। পালাবদল হয়েছে নেতৃত্বের। পরিবর্তন হয়েছে নামেরও। ৭৫ বছরে রাজনৈতিক দলটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য এনে দিয়েছে অনেক কিছু। ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, ৭০-এর নির্বাচন ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে দলটি। এত অর্জনের পরও দলটির ভিত নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেল। যে আদর্শ নিয়ে দলটির জন্ম হয়েছিল বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে সেই আদর্শের মিল পাওয়া কঠিন। এত পুরনো একটি রাজনৈতিক দল, ছাত্র আন্দোলনের মুখে এভাবে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল! ছাত্র-জনতার আন্দোলনে কেন দলের হাইকমান্ড থেকে শুরু করে সব নেতাকর্মীকে আত্মগোপনে যেতে হলো সেটিও ভাবনার বিষয় বলে মনে করছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা।
দীর্ঘ দিন টানা ক্ষমতায় থাকায় দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি। বরং ব্যবসায়ীমুখী প্রবণতা দেখা গেছে দলটির নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে ৬০ শতাংশের উপরে সংসদ সদস্যের চেয়ার ছিল ব্যবসায়ীদের জন্য বরাদ্দ। যেখানেই টাকাওয়ালা সেখানে দেওয়া হয়েছে মনোনয়ন। জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায়েও মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে। সেখানে বাদ পড়েছেন দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতারা। আবার এমপি কিংবা মন্ত্রীর আত্মীয়রাও ভাগিয়ে নিতেন উপজেলা বা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের মনোনয়ন। সব জায়গায়ই আত্মীয়করণের প্রবণতা ছিল প্রবল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির সিনিয়র নেতারা বলেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে দলের অনেকগুলো উইং দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তারা কোনো কাজ করতে পারত না। উপর মহলের নির্দেশ বাস্তবায়নে দিন পার করত। সেসব উইংয়ের যে নিজস্ব কিছু কাজ আছে সেগুলো ভুলে গিয়েছিল। সরকার পতনের এক মাস পেরিয়ে গেল। অথচ এই সময়ের মধ্যে সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিও দেওয়া গেল না! এতেই প্রমাণিত হয় উইংগুলো কাজের যোগ্যতা হারিয়েছে। এখন দলটাকে পুনর্গঠন করতে হবে। ব্যক্তি বিশেষে দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে না। রাজনীতিতে অভিজ্ঞদের অবহেলিত না করে কাজে লাগাতে হবে। আওয়ামী লীগকে সক্রিয় করতে হলে তৃণমূলকে সক্রিয় করতে হবে।
আওয়ামী লীগের একাধিক সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য বলেন, এখন তো দলকে পুনর্গঠন করার মতো সময় নয়। কিন্তু তারপরও দলকে পুনর্গঠন করতে হবে। যাদের কারণে আজ এমন পরিণতি তাদের চিহ্নিত করতে হবে। আপাতত নেতাকর্মীরা নিরাপদে থাকুক। সময় ও পরিস্থিতি বুঝে দলকে গোছাতে হবে।