মৌলভীবাজার সোনাপুরে স্থানীয় সাংবাদিক মাহমুদ এইচ খানের বাসায় সেই রাতের ঘটনা নিয়ে ফেইসবুকে একজন পোস্ট দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার রাতে তিনি থানায় মামলা করেন বলে পুলিশ জানায়।
ধর্ষণের মামলার প্রধান আসামি হলেন শহরের বড়হাট এলাকার সজীব তুষার (২৩)। সহযোগী হিসেবে ঢাকার মোহাম্মদপুরের মারজিয়া প্রভা ও মৌলভীবাজার কলিমাবাদের রায়হান আনছারীকেও আসামি করা হয়েছে।
এছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা অন্য মামলার আসামি হলেন মৌলভীবাজার কাজীর গাঁও এলাকার মোস্তফা কামাল খান (২৪)।
তুষার সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের মৌলভীবাজার জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ও শহর শাখার সভাপতি ছিলেন। এই অভিযোগ ওঠার পর তাকে সংগঠনের সব পদ থেকে ‘অব্যাহতি’ দেওয়া হয়েছে।
মৌলভীবাজার জেলা বাসদের জেলা বর্ধিত ফোরামের সদস্য রায়হান আনছারীকেও ‘সাময়িক অব্যাহতি’ দিয়েছে দলটি। এদিকে মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব সহযোগী সদস্য পদ থেকে মাহমুদ এইচ খানকে অব্যাহতি দিয়েছে।
মৌলভীবাজার মডেল থানার ওসি ইয়াছিনুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই তরুণী সোমবার রাতে ধর্ষণ ও ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগ এনে একটি এবং ফেইসবুকে ‘আপত্তিকর’ ছবি পোস্ট করায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আরও একটি মামলা করেছেন।
ওসি জানান, বাদীর অভিযোগ থেকে তিনি জানতে পারেন গত ৩ অগাস্ট সাংবাদিক মাহমুদ এইচ খানের মৌলভীবাজার সোনাপুরের বাসায় বন্ধুদের নিয়ে নৈশভোজের আয়োজনে সজিব তুষার তাকে নিয়ে গিয়েছিল। ওই বাসায় আড্ডা চলাকালে সিগারেটের সঙ্গে গাঁজা খাইয়ে নেশাগ্রস্ত করে একটি রুমে নিয়ে তাকে ধর্ষণ করেন তুষার। তাকে সহায়তা করে মারজিয়া প্রভা ও রায়হান আনছারী।
সেদিনের ঘটনার বিবরণে ধর্ষণের শিকার তরুণী বলেন, “আমার পূর্বপরিচিত তুষারের সাথে আমি একটি ডিনার পার্টিতে গিয়েছিলাম। সেখানে সে আমাকে গাঁজা খাইয়ে ধর্ষণের পরিকল্পনা করে রেখেছিল, আগে জানতাম না।
“আমি প্রথমে গাঁজা খেতে চাইনি, প্রভা ও রায়হান ভাই বলায় খেয়েছিলাম। কিন্তু অল্প খেয়েই আমার শরীর খারাপ লাগছিল। সেখানে সাধারণ সিগারেটের কথা বলে মাস্টারমাইন্ড ধর্ষক তুষার আমাকে গাঁজা খাইয়েছে। সবাই যখন টেবিলে খেতে বসছে তখন আমি একদম অসুস্থ হয়ে পড়ি এবং ঘুমাতে চাই। তখন ধর্ষক তুষার আমাকে বেডরুম দেখিয়ে দেওয়ার কথা বলে রুমে নিয়ে দরজা লাগিয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে।”
‘দুর্বল হয়ে পড়ায়’ প্রতিরোধ করতে পারেননি বলে উল্লেখ করেন ওই তরুণী। তিনি বলেন, পরে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন।
ঘটনার এত পরে মামলা করার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমি পরিবারের সম্মানহানির কথা ভেবে আর মামলাও করতে চাইনি তখন। পরে তারা এটাকে ধর্ষণ নয় বলে বক্তব্য দেয়। আমি ধর্ষণের শিকার হব, আবার ‘স্বাভাবিক সেক্স’ বলে আমাকে মিসট্রিট করা হবে, তা কতক্ষণ মেনে নেওয়া যায়? মানসিকভাবে এসব মেনে নিতে না পেরে আমি পরিবারের বাধা সত্ত্বেও মামলা করি।”
সাংবাদিক মাহমুদ এইচ খান বলেন, “আমার বাসাতে মারজিয়া প্রভাকে গেস্ট করেছিলাম। সেখানে সে ডিনার পার্টি করতে চাওয়ায় আমি সম্মতি দিই। তুষার একটি মেয়েকে নিয়ে আসবে, এখানে তুষার গাঁজা নিয়ে আসবে, এসবের কিছুই প্রভা আমাকে আগে জানায়নি।”
এদিকে এই ঘটনা নিয়ে ফেইসবুকে তুমুল আলোচনা চলছে।
মামলার আসামি নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফোরামের (নাসাসু) সমন্বয়ক মারজিয়া প্রভা এই ঘটনা নিয়ে ফেইসবুকে লিখেছেন, “সংগত কারণেই আমার পর্যবেক্ষণ, বোঝাপড়া কোনটাই আমি এইমুহুর্তে সোশ্যাল মিডিয়ায় দিচ্ছি না। যেহেতু পুরোটাই আইনি প্রক্রিয়ায় যাচ্ছে!
“যে অভিযোগ এসেছিল তা ঘটনার দুদিন পরে যখন প্রথম জানতে পারি, তখন থেকেই আমি আমার জায়গা থেকে আইনে প্রক্রিয়ার পক্ষে ছিলাম। যে প্রয়োজনীয়তা অনেক পরে অনুধাবন করা হলো।”
প্রভা লিখেছেন, “প্রথমেই আমি আসলে মেয়েটিকে ধন্যবাদ জানাবো। গাটস নিয়ে তিনি মামলা করেছেন বলে! আমাদের দেশে লিংগ ভিত্তিক সহিংসতার মামলার ক্ষেত্রে এই নারীটির এই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। কারণ ফেসবুক মিডিয়া ট্রায়ালের ভিকটিম আমরা যেমন হইছি, তিনিও হয়েছেন। কিন্তু তার হওয়াটা তাকে ভালনারেবল করে দেবার জন্য আরও যথেষ্ট ছিল।
“আমি আমার এই ক্ষুদ্র ২৮ বছর জীবনের যতটুকু নীতি নৈতিকতা নিয়ে কাজ করেছি, সেই জায়গা থেকে, একজন সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী হিসেবে আমি মেয়েটির এই সাহসিকতাকে সসম্মানে স্যালুট জানাই, হতেই পারে তিনি আইনের হিসাবে আমার প্রতিপক্ষ।”
এই ধর্ষণের ঘটনার বিচার চেয়ে মঙ্গলবার জেলা যুব কল্যাণ সংস্থা মঙ্গলবার মৌলভীবাজার মডেল থানা, মৌলভীবাজার পুলিশ সুপার ও মৌলভীবাজারের ডিসির কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে।
ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি তুষার ফেইসবুকে লিখেছেন, “মামলা হয়েছে, ওয়ারেন্ট এসেছে। শীঘ্রই আত্মসমর্পণ করে আইনের কাছে সোপর্দ করবো নিজেকে।
“যদি আমি অপরাধী প্রমাণিত হই তবে নিজের জন্য ক্ষমা নয়, বরং নিজের সর্বোচ্চ বিচারই চাইবো। কিন্তু যদি আমি নির্দোষ প্রমাণিত হই, তবে আমার সাথে যারা এই ঘৃণ্য অপরাধ করলেন, আপনাদের সবাই’কে আমি নিঃশর্তে ক্ষমা করে গেলাম।”
মামলার প্রতিক্রিয়ায় তিনি লিখেছেন, “অবশেষে মব জাস্টিস থেকে মুক্তি। ধন্যবাদ জানাই মেয়েটিকে। সত্য মিথ্যা বিচারটা এখন আদালতই করুক।”