রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে কানাডায় ‘আত্মগোপন’ করে আছেন স্ক্র্যাপ (জাহাজ ভাঙা) ব্যবসায়ী গাজী বেলায়েত হোসেন মিঠু ওরফে জি বি হোসেন। তিনি ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। আলোচিত এ ‘শিল্পপতি’ দুটি পাসপোর্টের অধিকারী। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রথমে তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট দিয়ে বিদেশে আসা-যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু তিনি কানাডিয়ান পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। ওই অবস্থায় গত ১৮ এপ্রিল দুদকের সহকারী পরিচালক এ কে এম ফজলে হোসেন তার দুটি পাসপোর্ট নম্বর উল্লেখ করে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেন। তারপরও তিনি বিদেশে চলে যেতে সমর্থ হন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির অনুসন্ধান দলের নেতা ও দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বলেন, ‘জি বি হোসেন আদালতের আদেশ নিয়ে বিদেশ যান। দুদকের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তিনি আদালতে আবেদন করেন। আদালত তাকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেয়। এরপর তিনি কোথায় গায়েব হয়ে গেছেন; সেটা আমরা জানতে পারিনি। বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা জানতে পেরেছি তিনি আজ ১১ বছরের মত কানাডার টরন্টোতে আছেন। তার বাড়ি ও কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা আমরা পেয়েছি। সেগুলোর বিষয় তথ্য চেয়ে আমরা শিগগিরই কানাডা সরকারের কাছে মিচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকুয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠাব।
বেসিক ব্যাংকে বেলায়েতের ঋণ কেলেঙ্কারি সম্পর্কে জানতে চাইলে সৈয়দ ইকবাল বলেন, বেলায়েত নিজের দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়েছেন। তার মধ্যে একটির ঋণ সমন্বয় করেছেন এবং অন্য একটি প্রতিষ্ঠান চালু আছে। তার ঋণের অধিকাংশই বেনামে। সেগুলো শনাক্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
কানাডা-প্রবাসী বাংলাদেশিরা জানিয়েছেন, বেলায়েত বর্তমানে টরন্টোতে থাকেন। মাঝখানে একবার বাংলাদেশে যাওয়ার পর দুদক তার বিদেশযাত্রায় স্থগিতাদেশ দেয়। এরপরও তিনি পুনরায় কানাডায় চলে আসেন। প্রায় নিয়মিত কলকাতায় গিয়ে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য তদারকি করেন। বেলায়েত টরন্টোতে ৮-১০টি পেট্রলপাম্পের মালিক। সেখানে কলাপাতা নামে তার একটি অভিজাত রেস্টুরেন্ট রয়েছে। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে ২ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার দিয়ে টরন্টোর ৯১, হিলক্রেস্ট স্কারবোরোতে বাড়ি এবং ২০১৯ সালের শেষের দিকে এজেক্সে কানাডিয়ান মুদ্রায় প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশীয় টাকায় যার মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৭০ কোটি টাকার মত) দিয়ে একটা শপিং প্লাজাও কিনেছেন। এছাড়া তার স্ত্রী নাহিদ আকতারের নামে “ভাসাভিস নাহিদ কালেকশন” নামে একটি বিপনি বিতানসহ বেশ কয়েকটি স্টোর হাউজের স্বত্তাধিকারী বনে গেছেন বেলায়েত হোসেন মিঠু।
কানাডায় অবস্থান করা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেলায়েত হোসেনের কিছু ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ জানিয়েছেন, মিঠু এবং নাহিদ আক্তার দম্পত্তির মূলত ২ সন্তান- বড় ছেলে ডাঃ নাহিয়ান গাজী এবং ছোট ছেলে রাফসান গাজী। বর্তমানে তারা দুজনেই আমেরিকা থেকে পড়াশুনা করছেন। বিশেষ করে বাঙ্গালি কোন সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামে প্রধান স্পন্সর কিংবা স্থানীয় সরকার প্রধানমন্ত্রী ট্রূডোর নির্বাচনী প্রোগ্রামে বড় অংকের আর্থিক সহায়তা করে থাকেন। মিঠুর স্ত্রী নাহিদ আকতার দাম্ভিকতার সহিত কানাডার টরন্টোতে বাংলা কমিউনিটিতে দাপিয়ে বেড়ান। তার মুখের উপর কেউ কথা বলতে গেলে অশালীন মন্তব্যসহ বিভিন্ন রকম অপদস্তের স্বীকার করেন। অনেকে তার অশালীন মন্তব্যের ভয়ে তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন।
এমনকি প্রতিষ্ঠানে রাখা কর্মচারীদের সাথে খারাপ আচরণসহ গায়ে হাত তোলার মত অপ্রীতিকর কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছেন বেলায়েত হোসেন মিঠুর বউ নাহিদ আক্তার। এমনকি চাল-চলনেও দাম্ভিকতার ছোয়া স্পষ্টমান, প্রতি ৬ মাস অন্তর অন্তর বিভিন্ন ব্রান্ডের দামি গাড়ি পরিবর্তনসহ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ব্রান্ডের পোশাক পরিচ্ছদ, পারফিউম ব্যবহার করে থাকেন নাহিদ আক্তার।
সম্প্রতি ৩রা জানুয়ারি মিঠু-নাহিদ দম্পতির ৩০ তম বিয়েবার্ষিকী অনুষ্ঠিত হলো। সেই অনুষ্ঠান কলাপাতা অভিজাত রেস্টুরেন্ট খুব রাজকীয় ঘটা করে পালন করেছেন এই দম্পতি।
প্রোগ্রাম শুরুর লগ্ন কেক কেটে স্ত্রীর গলায় ডায়মন্ডের নেকলেস পড়িয়ে দেন বেলায়েত হোসেন মিঠু।
অনুরূপভাবে, স্ত্রী নাহিদ আকতারও সাফার এবং ডায়মন্ড খচিত একটি রিং পড়িয়ে ৩০ তম বিবাহবার্ষিকী পালন করেন মিঠু নাহিদ দম্পতি।
দুদকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিচালক জানান, বেলায়েত বেসিক ব্যাংকের বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছেন মেসার্স বেলায়েত নেভিগেশনসহ বেশ কয়েকটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে। তার মূল ব্যবসা পুরনো জাহাজ এনে ভাঙা বা স্ক্র্যাপের। এসব ঋণ নেওয়ার জন্য বেলায়েত বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ও তৎকালীন গুলশান শাখার ম্যানেজার শিপার আহম্মেদসহ কয়েক কর্মকর্তাকে বিশাল অঙ্কের ঘুষ দেন। ঋণ জালিয়াতির এসব নথিপত্র তৈরি করে দিয়েছেন শিপার আহম্মেদ। দুদকের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে শিপার। বাচ্চুর বিরুদ্ধে দুদক এখন পর্যন্ত কোনো মামলা করেনি। তিনি দেশেই আছেন বলে জানা গেছে।
বেলায়েত বেসিক ব্যাংক থেকে যে ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তার বিস্তারিত তথ্য দুদক এখনো জানতে পারেনি। দুদকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জাহাজ আমদানির নামে চারটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান বেসিক ব্যাংকের দিলকুশা শাখা থেকে ১২৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর বিপরীতে তারা কোনো জাহাজ আমদানি করেনি। এর মধ্যে রিলায়েন্স শিপিং লাইনসের নামে ১৬ কোটি, বেলায়েত নেভিগেশন কোম্পানির নামে ২৪ কোটি, এসবিআই শিপিং লাইনের নামে ১৫ কোটি, বে নেভিগেশনের নামে ৭০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে এসব প্রতিষ্ঠান ছিল বেলায়েতের ও তার স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সিঙ্গাপুর থেকে জাহাজ রপ্তানিকারক একজন বাংলাদেশি। আবার আমদানিকারকও বাংলাদেশি। কিন্তু দেশে কোনো জাহাজ আসেনি। এলসির বিপরীতে দেনা শোধ করা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে দেশ থেকে টাকা পাচার হয়ে গেছে।’ দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, এ জালিয়াতির নেপথ্যে কারিগর বেলায়েত।
দুদক কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, রিলায়েন্স শিপিং লাইনসের স্বত্বাধিকারী জনৈক আসিফ ইকবাল ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর বেসিক ব্যাংকের দিলকুশা শাখায় একটি চলতি হিসাব খোলেন। যার শনাক্তকারী ছিল নাহিদ এন্টারপ্রাইজ নামের এক প্রতিষ্ঠান। শনাক্তকারী এ প্রতিষ্ঠানটি অস্তিত্বহীন ও হিসাব পরিচালনাকারী ভুয়া। বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ২০১২ সালে ২ ফেব্রুয়ারি এই হিসাব পরিচালনাকারীকে জাহাজ কিনতে ১৬ কোটি ১২ লাখ টাকার ঋণ দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ‘অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে জাহাজ ক্রয় করার নিমিত্তে বের করে নিয়ে এই অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।’ ঋণ হিসাবটি পর্যালোচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখেছে, এর থেকে ১৬ কোটি ৬ লাখ টাকা পে-অর্ডারের মাধ্যমে বেলায়েত নেভিগেশনের হিসাবে জমা হয়েছে। বেলায়েত নেভিগেশনের মালিক বেলায়েত হোসেন আসিফ ইকবালের আত্মীয়। বেলায়েত বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাইয়ের পদত্যাগের ঠিক এক দিন আগে কানাডায় চলে যান।
এছাড়া বেলায়েত নেভিগেশনের মালিকানায় থাকা ‘এমভি ওয়াটার কিং’ নামের একটি জাহাজ ভাঙার কথা বলে দেশে আনা হয়। কিন্তু ওই জাহাজটির প্রকৃত নাম ছিল এমভি নিনা। অভিযোগ রয়েছে, জার্মানি থেকে আনা জাহাজটি দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। যা নৌযান আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ২০১২ সালে তিনি বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিভোয়া) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। কোস্টাল শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) সভাপতি ও ওয়াটার ট্রান্সপোট কো-অর্ডিনেশন (ডব্লিউটিসি) সেলের আহ্বায়কের পদও বাগিয়ে নেন বেলায়েত। তার বিরুদ্ধে এসব সংগঠনের তহবিল লুটের অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে এমভি নিনা নামের একটি জাহাজ ভাঙার উদ্দেশ্যে আমদানি করে সীতাকুণ্ডের এসএ শিপ ব্রেকার্স। জাহাজটি না ভেঙে চট্টগ্রামের বাংলাবাজারে দুই মাস নোঙর করে রাখা হয়। এরপর ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে বিক্রি করে দেওয়া হয় বেলায়েত হোসেনের ভাই এমদাদ হোসেনের কাছে। সেই জাহাজটি পরে কিনে নেন বেলায়েত হোসেন। দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এমভি মেহনুর নামক ছোট ও পুরাতন একটি জাহাজের কাগজপত্র ব্যবহার করে এমভি নিনা জাহাজটিকে রাতারাতি নাম পাল্টে ওয়াটার কিং নাম দেন বেলায়েত। যার প্রমাণ মিলে ওয়াটার কিংয়ের রেজিস্ট্রেশন নম্বর থেকে। এমভি মেহনুর জাহাজটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল সি.৭৮৫, ওয়াটার কিংয়ের রেজিস্ট্রেশন নম্বরও সি.৭৮৫ দেখানো হয়। জাহাজটির দৈর্ঘ্য ২৬১ দশমিক ৩৯ ফুট ও ধারণক্ষমতা তিন হাজার টন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নদীপথে এত বড় জাহাজ ব্যবহারের নিয়ম নেই। সর্বোচ্চ ২৫০ ফুট পর্যন্ত দৈর্ঘ্যরে জাহাজ ব্যবহার করা সুযোগ রয়েছে। এছাড়া ওয়াটার কিংয়ের গ্রস রেজিস্ট্রার টনেজ (জিআরটি) দেখানো হয়েছে ১ হাজার ১৯৫ দশমিক ৫ টন, প্রকৃতপক্ষে জাহাজটির জিআরটি ১ হাজার ৭১৩ টন। এ বিষয়ে জাহাজ ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ সরকারের বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে ঘুরেও কোনো সুফল পাননি।
অভিযোগ রয়েছে, ভাঙার জন্য আনা জাহাজটি শুল্ক দিতে হয় টনপ্রতি ১৮০০ টাকা। সেই হিসাবে শুল্ক দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা (৯৩৫ এলডিটি গুণ ১৮০০)। অন্যদিকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে আনা জাহাজের শুল্ক জাহাজের মূল্যের ৩৫ শতাংশ। সেই হিসাবে এমভি ওয়াটার কিংয়ে প্রায় ২ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয়। এমভি ওয়াটার কিংকে বন্ধক রেখে বেসিক ব্যাংক থেকে ১০ কোটির বেশি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন বেলায়েত।
বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ৩০০ কোটি টাকার ঋণ ১২টি কোম্পানির নামে দেওয়া হয়। এর মধ্যে এসএফজি শিপিং লাইন, এস রিসোর্সের শিপিং লাইন, এস সুহী শিপিং লাইন, শিফান শিপিং লাইন, এশিয়ান শিপিং লাইন, ল্যাবস এন্টারপ্রাইজ, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি, ডেল্টা সিস্টেমস লিমিটেড, ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজ, গ্রীন বাংলা হোল্ডিং কিয়েব ট্রেডিং এবং এম নাছিরউদ্দিন, বাসগৃহ প্রোপাটিজ। এসব প্রতিষ্ঠান ঋণের টাকা নিজেদের অ্যাকাউন্টে লেনদেন না করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে পে-অর্ডারের মাধ্যমে তুলে নেয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই একাধিকবার টাকার হাতবদল হয়েছে। ফলে প্রকৃত সুবিধাভোগী কে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো সব ক্ষেত্রে শনাক্ত করতে পারছে না। ১৭টি ব্যাংকের ২৪টি শাখা থেকে ৩৩টি প্রতিষ্ঠান ও ৮ ব্যক্তির নামে ৩০০ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়। এর মধ্যে একাধিক শিপিং লাইনের সঙ্গে বেলায়েতের সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
বেলায়েতের বিরুদ্ধে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন সেলের (ডব্লিউটিসি) তহবিল লুটপাটেরও অভিযোগ রয়েছে। ডব্লিউটিসির এক তদন্ত প্রতিবেদনেও বেলায়েতের বিপুল অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি উঠে আসে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৬ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মোবাইল কোর্ট পরিচালনা বন্ধ রাখার খরচ হিসেবে ৪ লাখ টাকা নেন বেলায়েত। ২০০৬ সালের ২৩ অক্টোবর নৌ, কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ঈদ বোনাস দেওয়ার নামে লুটপাট করা হয় ৬ লাখ ২ হাজার টাকা। ২০০৬ সালের ১৮ জুন অনুষ্ঠিত ডব্লিউটিসি মতবিনিময় সভার খরচ বাবদ লুটপাট করা হয় ৬ লাখ টাকা। একই বছর ২৩ অক্টোবর লাইটারেজ শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের বিশেষ ঈদ বোনাস প্রদানের নামে ৮৫ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়। এ বছর ২৯ মে মেঘনা ঘাট এলাকায় নৌশ্রমিকদের সম্মানে ভোজ অনুষ্ঠানের নামে খরচ করা হয় ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। মিডিয়াতে তথ্য প্রকাশের নামে ২০০৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি খরচ দেখানো হয় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ডব্লিউটিসির পক্ষে ২০০৫ সালের কয়েকটি মামলা পরিচালনার জন্য প্রয়াত আইনজীবী ড. এম জহিরকে ২০০৬ সালের ১ মার্চ ১২ লাখ টাকা দেওয়ার মিথ্যা ভাউচার দিয়ে আত্মসাৎ করা হয়। পরে ড. জহির ওই টাকা নেননি বলে দাবি করেন।
এ রকম আরও বেশ কিছু অনিয়মের তথ্যে দেখা গেছে, আইনি খরচের নামে ২০০৬ সালের ২১ জানুয়ারি এমভি সিলটিক জাহাজের বিপরীতে ২৪টি লাইটার জাহাজের জন্য ২ লাখ টাকা চেকের মাধ্যমে দেওয়ার অনুমোদন দেন বেলায়েত। ২০০৬ সালের ১৮ মার্চ মেসার্স প্রিয়াংকা ওভারসিজের মামলা বা নিষ্পত্তির নামে নেন ৫ লাখ টাকা। ২০০৬ সালের ১৮ মে বোঝাই করা ২৪টি লাইটারের গম খালাসের নামে ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা খরচের কথা বলা হয়। একই বছর ২৯ জুলাই অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে খরচের নামে ১০ লাখ টাকা প্রদান করা হয়। এ বছর ২৩ অক্টোবর আটক জাহাজের নাম খারিজের নামে খরচ করা হয় ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
এসব টাকা লুটপাটে তার স্ত্রী নাহিদ আখতারেরও সম্পৃক্ততা ছিল। ডব্লিউটিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নাহিদ আখতার ১৫ লাখ, আমির হোসেন ৩০ লাখ, মো. নুরুল হক ২৫ লাখ ও মো. তাজুল ইসলাম ১০ লাখ টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে গ্রহণ করেন।
জানা গেছে, ২০০৭ সালে ১/১১-এর সময় বেলায়েত কানাডায় পাড়ি জমান। পরে ২০১২ সালে একবার কানাডিয়ান পাসপোর্টে বাংলাদেশে আসেন। পরে আবার চলে যান। দুদক তার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয়। এই অবস্থায় ২০১৯ সালে তিনি কানাডিয়ান পাসপোর্টে বাংলাদেশে আসেন। গত ২৮ মার্চ পুলিশের বিশেষ শাখার কাছে দুদকের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার চিঠিতে বলা হয়, ‘বেসিক ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে অবৈধ প্রক্রিয়ায় ভুয়া ঋণের নামে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয় কমিশনে অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। এ বিষয়ে ৬১টি মামলা করা হয়েছে যার তদন্ত চলমান। অবশিষ্ট অনুসন্ধান দ্রুত অনুসন্ধানের জন্য জি বি হোসেন তথা গাজী বেলায়েত হোসেন কর্র্তৃক বেসিক ব্যাংক থেকে অবৈধ প্রক্রিয়ায় ভুয়া ঋণ হিসেবে ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় তিনি অতি সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন এবং পুনরায় যেকোনো মুহূর্তে দেশত্যাগ করে চলে যাবেন। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তার বিদেশ গমন রহিতকরণ প্রয়োজন।’ তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট নম্বর বিআর ০৫০২১০৯, কানাডিয়ান পাসপোর্ট নম্বর এবি ৯৪৫৭২৭। ঢাকার ঠিকানা বাড়ি নং ২/এ, রোড নং ১১৯, গুলশান-২ ঢাকা।